অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব বেইল আউট প্যাকেজ ঘোষণার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

রাজস্ব আহরণে ধীরগতি, রপ্তানি কমে যাওয়া, বেসরকারি খাতে ঋণের গতি মন্থর, শেয়ারবাজারে অস্থিরতাসহ নানা কারণে দেশের অর্থনীতি কয়েক মাস ভালো যাচ্ছিল না। এর মধ্যে নতুন করে যোগ হয়েছে এক বৈশ্বিক 'বিপদ' করোনাভাইরাস। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে। প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। এর মধ্যে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত পোশাক শিল্প বিপদে পড়েছে। কমে গেছে সার্বিক আমদানি। কমছে অভ্যন্তরীণ চাহিদা। করোনা দীর্ঘস্থায়ী হলে দেশে অর্থনীতির সংকট যে আরও তীব্র হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মনেও কোনো সংশয় নেই।
এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সংকট মোকাবিলায় একটি 'বেইল আউট প্যাকেজ' তৈরি করে শিগগিরই তা ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোক্তারা। একই সঙ্গে করোনার কারণে খাতভিত্তিক আর্থিক ক্ষতি হিসাব করে সেই অনুযায়ী স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তারা জানিয়েছেন, করোনার প্রভাব থেকে অর্থনীতিকে বাঁচাতে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশই ইতোমধ্যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। নানা ধরনের নীতি-সহায়তা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশকেও এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সরকারের জন্য কঠিন হবে। এ কাজে সরকারকে সহায়তা করতে চান ব্যবসায়ীরা। তাই সমাধানের উপায় খুঁজে বের করতে এফবিসিসিআইসহ শীর্ষ চেম্বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করার কথা বলেছেন তারা।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় যুক্তরাজ্য সরকার ৩৩০ বিলিয়ন ডলারের বেইল আউট প্যাকেজ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা চাঙ্গা করতে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার কমিয়ে দিয়েছে। ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পৃথক তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশ পৃথকভাবে নীতি-সহায়তার কথা ঘোষণা করেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি। অর্থমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো দিকনির্দেশনা আসেনি। তিনি আরও বলেন, নীতি সহায়তা দেওয়া চলমান প্রক্রিয়া। প্রয়োজন হলে আরও বেশি প্রণোদনা দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ডিসেম্বরে করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জানুয়ারি মাসে আমদানি কমেছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে আরও খারাপ অবস্থা। ওই মাসে আমদানি কমেছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, মার্চে এলসি খোলার সংখ্যা আগের মাসের চেয়ে ব্যাপক কমে গেছে। ফলে মার্চে আমদানি আরও কমবে। রপ্তানি আয়ের শীর্ষ খাত বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মূলত আমদানি করা কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল এবং চীন থেকে সিংহভাগ কাঁচামাল আসে। চীনে ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ থাকায় গত দুই মাসে কাঁচামাল আনা যায়নি। ফলে স্থানীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের শিপমেন্টে ব্যাহত হয়েছে। পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের বড় বাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র। ওই সব দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ায় অনেক ক্রেতা রপ্তানি আদেশ বাতিল করে দিয়েছে। পোশাকের পাশাপাশি অন্যান্য খাতের রপ্তানিও ব্যাহত হচ্ছে। এই ক্ষতি পোষাতে নানা ধরনের প্রণোদনা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বিজিএমইএ।
এনবিআর সূত্র বলেছে, করোনার কারণে রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে আমদানি শুল্ক্ক আদায় তলানিতে ঠেকেছে। ফ্রেব্রুয়ারিতে আমদানি শুল্ক্ক আদায় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ব্যাপক কমে গেছে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ তথা মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আহরণ কমেছে। কমে গেছে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধি। নতুন বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। শেয়ারবাজারেও ভয়াবহ পতন হয়েছে। যদিও গত বৃহস্পতিবার কৃত্রিমভাবে নতুন বিধিবিধান জারি করে বাজারে ধস ঠেকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, নীতি-সহায়তা দিয়ে অর্থনীতি চাঙ্গা করার তেমন সুযোগ নেই। সংকট মোকাবিলায় নতুন উপায় খুঁজে বের করতে হবে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ অনেক দেশে প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশকেও সেই পথে যেতে হবে। তবে সুবিধা দিতে হলে একটি নীতিমালা তৈরি করতে হবে সরকারকে। নজর দিতে হবে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের দিকে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, অভ্যন্তরীণ চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে। করোনা দীর্ঘস্থায়ী হলে ধস নামবে পোশাক খাতে। সংকট মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে এখনই উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, তিন মাসের জন্য একটি বেইল আউট প্যাকেজ তৈরি করতে হবে। এর জন্য জিডিপির ১ শতাংশ বা ২৫ হাজার কোটি টাকার আলাদা তহবিল গঠনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, অর্থনীতিতে এই টাকা সঞ্চালন হলে তখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা চাঙ্গা হবে। পাশাপাশি রপ্তানিমুখী শিল্পে আরও নীতি-সহায়তা দিতে হবে। রাজস্ব আয়ের অবস্থা খারাপ, কোথা থেকে টাকার জোগান দেবে সরকার- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রয়োজনে টাকা ছাপাতে হবে। ট্রেজারি ও বন্ড বিক্রির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে হবে। এটা করা হলে তো মূল্যস্ম্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা সম্পর্কে তিনি বলেন, বাড়বে না। কারণ সাধারণ মানুষের পকেটে টাকা নেই। ফলে বাজারে অতিরিক্ত টাকা সরবরাহ হবে না। মূল্যস্ম্ফীতির ওপর প্রভাব পড়বে না।
বিশিষ্ট শিল্প উদ্যোক্তা ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, সংকট বিশ্বজুড়ে হলেও বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। নানা কারণে অর্থনীতি চাপে ছিল। করোনার কারণে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে। নতুবা অর্থনীতি আরও খারাপের দিকে যাবে। তখন সামাল দেওয়া কঠিন হবে। খাতভিত্তিক সহায়তা দিতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে বেইল আউট প্যাকেজ তৈরি করতে হবে। এ জন্য শীর্ষ ব্যবসায়ীদের নিয়ে অচিরেই আলোচনায় বসার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মেয়াজ্জেম মনে করেন, করোনা দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ জন্য কোন খাতে কী প্রভাব পড়বে সে বিষয়ে সরকারকে মূল্যায়ন করতে হবে। যেসব খাত প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত তাদের সহায়তা দিতে হবে। অর্থ জোগানের ক্ষেত্রে নিজস্ব সম্পদের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ অন্যান্য দাতা সংস্থার কাছে শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ, অনেক দাতা সংস্থা করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাংলাদেশকে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

 

সংগ্রহে - সমকাল